
দেবাশিস মৌলিকঃ একটা প্রচলিত কথা আছে, জিতার ডালায় মা দুর্গা আসেন । জিতাষ্টমী শেষ হলেই শারদীয়া পুজো যেন ঘরেই ঢুকে যায় । বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে মল্লরাজ পরিবারে জিতাষ্টমীর পরদিন থেকেই দুর্গাপুজো শুরু হওয়া আজও রীতি এবং ঐতিহ্য । এবারেও তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজপরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে । মল্লরাজ নগরীতে এখন পুজোর আমেজ । মল্লরাজ পরিবারের এই দুর্গামাতা মৃন্ময়ীরূপে খ্যাত । এ-বছর ১০২৯ বছরে পড়লো এই জাগ্রত মহাপুজো । পিতৃপক্ষের নবমী তিথি থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত চলে এই পবিত্র পুজো । হাতে লেখা মন্ত্র পড়ে চলে পুজোপাঠ । রয়েছে মৃন্ময়ী দেবীর পাকা প্রাচীন মন্দির । বিষ্ণুপুর শহরের এটি একটি প্রাচীন মন্দির । দশম শতাব্দীতে ঊনিশতম রাজা মল্লরাজ শ্রীমন্ত জগৎমল্ল দেব এই মন্দির নির্মাণ করেন । প্রতিষ্ঠার তারিখ ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্। এই পূজার আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত দুর্গাপূজার আচার অনুষ্ঠান থেকে বেশ ফারাক রয়েছে । পুজোয় মূল-মূর্তি ছোট ঠাকুরাণী বিসর্জিত হন না । ঘট স্থাপন করে পটে আঁকা মা দুর্গার পুজো করা হয় । কৃষ্ণা নবমী তিথিতে দেবীর বোধন হয় । পুজো চলাকালীন দিনগুলোতে প্রতিদিন সন্ধিকালে তোপধ্বনি করবার রীতি রয়েছে ।
তবে ১০২৮ বছর পেরিয়েও অমলিন বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির এই পুজো। প্রাচীন পুজো শুরুর সাথে সাথে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন প্রাচীন মল্লগড়ের আপামর মানুষ।
স্থানীয় মাধব সায়রে স্নান করিয়ে বড় ঠাকুরানীকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। দেবীর আগমনের নির্ঘন্ট সূচীত হয় মুহুর্মুহু কামানের শব্দে।
কথিত আছে ১৯ তম মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন মল্ল রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে শিকারে বেরিয়ে পথ ভূলে বন বিষ্ণুপুরে গিয়ে পড়েন। আজ যেখানে দেবী মৃন্ময়ীর মন্দির ঠিক সেখানেই বিভিন্ন দৈব ঘটনার সম্মুখীন হয়ে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি । পরবর্তীতে মল্ল রাজত্ব প্রদ্যুম্নপুর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিষ্ণুপুরে। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে মহাসমারোহে দেবী মৃন্ময়ীর পুজো শুরু করেন জগৎমল্ল। কথিত আছে প্রথম দিকে শাক্ত মতে এই পুজো শুরু করেন মল্ল রাজারা। স্বাভাবিক ভাবে সে সময় এই পুজোয় চালু ছিল বলিদান প্রথা। একসময় এই পুজোয় নরবলির প্রথা ছিল। পরবর্তীতে বিষ্ণুপুর রাজ পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হলে পুজোর আচারে কিছু বদল করা হয়।নবলিদান প্রথা বন্ধ হয়ে শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করে শুরু হয় তোপধ্বনী প্রথা। তারপর থেকে শতকের পর শতক ধরে দেবী মৃন্ময়ীর পুজোর প্রতিটি নির্ঘন্ট ঘোষিত হতে থাকে তোপধ্বনীর মধ্য দিয়ে। হাজার বছর পার হলেও সেই প্রাচীন রীতি আজও অব্যাহত মল্লগড় বিষ্ণুপুরে। আজও প্রাচীন রীতি মেনে জিতাষ্টমীর পরের দিন স্থানীয় গোপাল সায়রের পারে মূর্চ্ছাপাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গর্জে ওঠে কামান। গোপাল সায়রে একপ্রস্থ পুজো পাঠ সেরে দেবীরই এক রূপ বড় ঠাকুরানীকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। ঘট স্থাপন করে রাজমহল থেকে রূপার পাত দিয়ে তৈরী মহিষমর্দিনী মূর্তিকে বোধনের মাধ্যমে পুজো শুরু হয় । মানচতুর্থীর পরের দিনে লালরঙের কাপড়ে স্থানীয় বিশ্বাসে মেজঠাকুরানিকে দেবীঘটে গোপালসায়র থেকে জল ভরে আনা হয় । মহাষষ্ঠীর দিনে রাজপরিবারের সদস্যদের আগমন ঘটে মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে । সেখানকার রাজ অভিষেকের জায়গায় বিষ্ণুপুরের রাজা ও রাণীকে দেবীপট বা ছোটঠাকুরানিকে দর্শন করানো হয় । শ্যামকুন্ডের জলে দেবীপটকে স্নান করিয়ে বিল্ববরণ ও বোধন করা হয় । প্রাচীন এই পুজোতে ভোগ ব্যবস্থার রীতিও বেশ সাবেকি । পুজো শুরু থেকে মহাষষ্ঠী অবধি খিচুড়িভোগ এবং মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমী পর্যন্ত বাদশাভোগ চালের ভাত নিরামিষ ভাজাভুজি সহ বহু পদ জোগানো হয় ।
মল্লরাজাদের শাসনকালে স্থানীয় মহাদণ্ড বা মহাহোড় সম্প্রদায়দের পাথর দরজার কাছে কামান দেগে সন্ধিপুজো হত। আজও রীতি ও ঐতিহ্য মেনে কামান দাগা হয়ে থাকে । কামান দাগা প্রত্যক্ষ করবার জন্য হাজার হাজার লোকের সমাগম এখনও হয় ।
সন্ধিপুজো চব্বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা রীতি । মহানবমীর শেষ রাতে মহামারীর পুজো হয় । জনশ্রুতি আছে, এক সময় কলেরার মড়কে মল্লভূম রাজ্যের ও রাজপরিবারের বহু লোকের মৃত্যু হলে মহামারী পুজোর প্রচলন শুরু হয় । এই মহাপুজোতে ব্যতিক্রমী রীতি রয়েছে খচ্চর বাহিনীর পুজোতে । দু'জন পুরোহিত রাজপরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে দেবীঘটের দিকে পিছন ফিরে খচ্চর বাহিনীর পুজো করেন । পাঁচ পোয়া করে বাদশাভোগ চাল, মুগ ডাল, ঘি, কাঁচকলা ও সন্ধব লবণ দিয়ে রান্না করা এই পুজোর বিশেষ ভোগ । সুর্যোদয়ের পরে রাজপরিবারের সদস্যদের এই ভোগ খাওয়া চলে না । তাই সূর্য উঠার আগেই এই মহাভোগ রাজপরিবারের সদস্যদের খেয়ে নিতে হয় ।
মহাদশমীর দিন দেবীর ভোগে নিবেদিত হয় পান্তা ভাত । নীলকন্ঠ পাখি আজও এই মহাপুজোতে উড়ানোর রীতি রয়েছে । রাউতখন্ডের ন্যুলে সম্প্রদায়ের লোকেরা নীলকন্ঠ পাখি নিয়ে আসেন । দেবীমূর্তিকে বিসর্জন না দিয়ে দেবীঘটকে স্থানীয় রামসায়রে নবপত্রিকাসহ বিসর্জন দেওয়া হয় । মল্লরাজ পরিবারের এই প্রাচীন পুজোর বিশেষত্ব হল পটে আঁকা তিন ঠাকুরাণী যথা বড় ঠাকুরাণী, মধ্যম ঠাকুরাণী, ছোটো ঠাকুরাণীর সঙ্গে একসাথে চলে মা মৃন্ময়ীর পুজো । ভারতবর্ষে এমনটি আর কোথাও হয়না । তিন ঠাকুরাণী আসলে মা দুর্গার ভিন্ন তিন রূপ । মহাকালী, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতী । মহাষ্টমীতে উগ্রচন্ডার পুজো হয় । রাজপরিবারের জমিদারি আজ আর নেই । ফলে ঐতিহ্যবাহী এই পুজোর খরচ সামলাতে হয় রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যদের । তবে বিষ্ণুপুর পুরসভা এই মহাপুজোতে বেশ ভালো একটা অনুদান দেন । এভাবেই চলছে বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের দশভুজা মহিষমর্দিনী মৃন্ময়ী মা ও তিন মহাঠাকুরাণীর মহাপুজো ।।